Friday 26 September 2014

বাংলা বানান : সমস্যার ইতিবৃত্ত / ড. মোহাম্মদ আমীন

বাংলা বানান : সমস্যার ইতিবৃত্ত

জনসংখ্যা বিবেচনায় বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ ভাষা। বাইশ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষায় কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সে বিবেচনায় বাংলা ভাষার সীমাবদ্ধতা বলা যায় অতি নগন্য। ফেরদাউস খান পরিচালিত একটি সমীক্ষার  প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলা ভাষার লিখন গতি ইংরেজি ভাষার সমান কিন্তু পঠন বেগ ইংরেজির চেয়ে বেশি। ইংরেজি লিপি ধ্বনিমূলক নয়, বর্ণানামূলক। একটি ধ্বনির প্রতিলিপি হিসেবে ইংরেজিতে একটি বর্ণ সৃষ্টি হয় না। উদহারণস্বরূপ ÔgÕ বর্ণের কথা বলা যায়। এটি কখনও ‘ বর্গীয়-জ’ কখনও বা ‘গ’। আবার কখনও উচ্চারণই হয় না। ইংরেজিতে অনেকগুলো শব্দ রয়েছে যেখানে বর্ণচিহ্ন উপস্থিত থাকলেও উচ্চারিত হয় না এবং বর্ণের উচ্চারণে প্রবল পার্থক্য লক্ষ্যণীয়। ইংরেজির এ অবিজ্ঞানোচিত ও রীতিবিহীন উচ্চারণ-রীতি সংস্কার করে ধ্বনিমূলক পদ্ধতিতে বিজ্ঞানোচিত ইংরেজি লেখার পদ্ধতি প্রচলনের জন্য জজ বার্নড শ মোটা অঙ্কের অর্থ উইল করে গিয়েছিলেন।  কিন্তু ইংরেজি ভাষা এত বেশি অবৈজ্ঞানিক যে, তা ঠিক করা সম্ভব হয় নি।
প্রত্যেকটি ধ্বনির জন্য বাংলায় নির্দিষ্ট হরফ আছে।  ‘ক’ বর্ণের উচ্চারণ সবসময় সর্বত্র অভিন্ন। ইংরেজি বর্ণমালার দ্বিতীয় অক্ষর সি (C) এর মত ভিন্নভাবে উচ্চারিত হওয়ার মত জটিলতা বাংলা ভাষায় নেই। আবার কোন বর্ণের অর্ধ উচ্চারণ প্রয়োজন হলে হসন্ত দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়ার রীতি বাংলা ভাষার একটি বাড়তি সুবিধা। বাংলা বর্ণ শুধু যে ধ্বনিমূলক তা নয়, এর স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণ একটি করে অক্ষর বা Syllable কে ধারণ করে রাখে। অন্যদিকে বাংলা স্বরবর্ণগুলো অভ্রান্ত ধ্বনিমূলক। ব্যঞ্জনবর্ণগুলো শুধু অভ্রান্ত ধ্বনিমূলক নয়, অন্তর্নিহিত ধ্বনির অতিরিক্ত একটি ‘অ’ স্বরধ্বনিরও দ্যোতক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ফলে একটি বর্ণের সাহায্যে বাংলায় একটি পূর্ণ অক্ষর প্রকাশ করা সম্ভব। বাংলা ভাষার ধ্বনিবোধক বাংলা প্রতিলিপি ব্যবহারে এমন সুসামঞ্জস্য পৃথিবীর আর কোন ভাষায় নেই।

অনেকে যুক্তাক্ষরকে বাংলা ও বাংলা বানানের সমস্যা বলে মনে করে থাকেন। ভাষা কিংবা বানান উভয় বিবেচনায় যুক্তাক্ষর সমস্যা নয, বরং সুবিধা। যুক্তাক্ষর শব্দের যথার্থ উচ্চারণে সহায়তা করে। বাংলা যুক্তাক্ষরগুলো ধ্বনি প্রতিলিপি হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাশ্রয় বিবেচনায় বিস্ময়কর শৃঙ্খলাজাত কৌশল। এটি শুধু অভ্রান্ত নয় অতি সুক্ষ্ণ বিবেচনাতেও একটি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়াস হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের ‘দানুকে’ ইংরেজি ভাষায় ‘ডানো’, বড়জোর ‘ডানু’ ছাড়া আর কিছু লেখা সম্ভব নয়; কিন্তু ইংরেজি শব্দ DuncanÕ কে বাংলায় সহজে ‘ডানকান’ লেখা যায়। বাংলায় লেখা যায় না, এমন ধ্বনি খুব একটা বেশি নেই।

পৃথিবীতে প্রতি বছর ৭টি করে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যার বিলুপ্তি ভাষা-বিলুপ্তির প্রধান কারণ। সে হিসেবে বাংলা ভাষার অবস্থান পতনের দিকে নয়, উত্থানের দিকে। পৃথিবীতে চারটি ভাষাও যদি টিকে থাকে তম্মধ্যে একটি হবে বাংলা।  তবে, আমরা যারা বাংলা ভাষায় বলি এবং লিখি, বিশেষ করে শিক্ষিত  ও উচ্চশিক্ষিত হিসেবে পরিচিত- তাঁদের অনেকের কার্যকলাপ বাংলা ভাষাকে ক্রমশ বিপন্নতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পণ্ডিতদের লেখা-লেখি বাংলা বানান ও উচ্চারণ রীতির বিরাট প্রতিবন্ধক। তাঁদের লেখা ও বানানে পারস্পপরিক ভিন্নতা সাধারণ পাঠকদেরকে বাংলা বানান ও শব্দচয়নে সাংঘাতিকভাবে স্বেচ্ছাচারী করে তুলছে। ভাষার অভ্যন্তরীণ রীতি-নীতির তুঘলকি সিদ্ধান্ত ও দায়-বোধহীন চিন্তা-চেতনা বাংলা ভাষাকে ক্ষয় রোগের মত পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পণ্ডিতবর্গের বানান বিষয়ক মতানৈক্য বাংলা ভাষার বিদ্যমান জটিলতার মূল কারণ। মাছের মায়ের বাচ্চা খাওয়ার মত আমাদের ভাষাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা বাংলা ভাষাকে আস্তে-আস্তে যেন খেয়ে ফেলছেন। একবিংশ শতকে এসেও বুদ্ধিজীবীরা বাংলার মত একটি সুসমৃদ্ধ ভাষাকে সমতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারছেন না।  এ ব্যর্থতার দায় তাঁরা কীভাবে এড়াবেন?

অনেকে মনে করেন, একই ধ্বনির জন্য একাধিক চিহ্নের  ব্যবহার বাংলা বানান জটিলতার প্রধান কারণ। তাঁদের ধারণা আংশিক সত্য, কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষা ইংরেজির চেয়ে বাংলার সমস্যা ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় অনেক কম। বুদ্ধিজীবীরা বলে থাকেন (ই, ঈ), (উ,ঊ), (ঙ,ং), (জ,য), (ত,ৎ), (ণ,ন), (শ,ষ,স) বর্ণগুলোর সমোচ্চারিত স্বভাব, প্রায় ২৬০টি যুক্তাক্ষর এবং তাদের সমোচ্চারণ বাংলা বানানের প্রধান সমস্যা। কিন্তু এ সমস্যা কি ইংরেজি ঋটঞটজঊ সমস্যার চেয়েও মারাত্মক? চারশ শব্দের একটি ইংরেজি প্রবন্ধে শব্দের উচ্চারণ ও বানান বিষয়ে যে সমস্যা হতে পারে বাংলা ভাষার চার হাজার শব্দের গ্রন্থেও  অনুরূপ সমস্যা হবার কোন অবকাশ থাকে নো। বানানে বর্ণ স্থাপনে ঐকমত্য সৃষ্টির মাধ্যমে সমোচ্চারিত শব্দ-সমস্যা সহজে দুরীভূত করা যায়। অনেকে ইংরেজি ভাষাতেও বানানের মতানৈক্যের কথা উল্লেখ করে বৃটিশ ও আমেরিকান ইংরেজির উদাহরণ টেনে থাকেন। তা সহস্র মাইল ব্যবধানের দুটি দেশের কথা। তাছাড়া সংখ্যায় এত কম যে, উদাহরণে আনতে লজ্জা করে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে একই বাড়িতে বসবাসরত দুজন পণ্ডিতের কলম হতে একই শব্দের ভিন্ন বানান বেরোতে দেখা যায়। রাজনীতির মত এখানে বানানেও অগণিত রীতি, যেন ষোল কোটি বাঙ্গালির ষোল কোটি ভাষা। বড় ভাই লেখেন  ‘বিদেশী’ ছোট ভাই ‘বিদেশি’। সমতাভিত্তিক বানান রীতি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রায়-সমোচ্চারিত বর্ণ-চিহ্নসমূহের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে অতি সহজে সমোচ্চারিত বর্ণ জটিলতা দুরীভূত করা যায়।

সমধ্বনি যুক্তব্যঞ্জনের আধিক্যকে বাংলা ভাষার আরেক সমস্যা বলে ভাষাবিদরা চিহ্নিত করে থাকেন। সমোচ্চারিত ধ্বনি ও সমোচ্চারিত যুক্ত ব্যঞ্জনের কারণে বাংলা ভাষায় বহু সমোচচারিত শব্দ দেখা যায়। অনেকের অভিযোগ (ত্ত, ত্ব, ত্ত্ব, ত্য), (শ্ব, স্ব, শ্য, ষ্য, স্য) প্রভৃতি যুক্তব্যঞ্জনগুলো শব্দের বানানে ভুলের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষায় ভুল হয়। নইলে ড. আনিসুজ্জামান বাঙালী লিখেন কেন? কেন নরেন বিশ্বাস বাঙালা লিখেন? বাংলা শব্দটি লেখাতে যে বাঙালি মতৈক্যে পৌঁছতে সক্ষম হচ্ছেন না, তাদের দুরদর্শিতা কত কাঁচা তা সহজে অনুমেয়। ভুল হওয়া আর বিধি-বিধানের সমতা না থাকার কারণে ভুল করা এক কথা নয়। এরূপ ভুলকে ‘ভুলের নিয়ম’ অনুসরণে সাধিত ভুল বলা যায়। সাধারণ লোকেরা ভুল এবং বুদ্ধিজীবীর ভুল, এক পাল্লায় পরিমাপ করা উচিত নয়। ‘শ্রেণী’ লিখব না ‘শ্রেণি’ লিখব তা ঠিক করতে না পারা বানানগত জটিলতা নয়, রীতিগত জটিলতা। সমোচ্চারিত যুক্তব্যঞ্জন সমস্যা সৃষ্টি করলে তা সমাধান করা হচ্ছে না কেন? ভাষার সমস্যা সমাধানে ভাষাবিদরা ব্যর্থ হলে তাদের থেকে লাভ কী? ভাষাবিদদের কাজ তো ভাষার সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা, তা কি তাঁরা করছেন?

বাংলা ভাষায় নাকি ধ্বনিভিত্তিক বর্ণের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়- এমন অভিযোগও কেউ কেউ করে থাকেন। কোন কোন ধ্বনির জন্য হরফের অভাব- এরূপ অভিযোগও শোনা যায়। বিদেশাগত শব্দের ক্ষেত্রে এ রকম সমস্যা মারাত্মক বলে মন্তব্য দিয়ে জনৈক বুদ্ধিজীবী জানান, ‘অ্যা’ স্বরধ্বনির কোন বর্ণ বাংলা ভাষায় নেই। আমার মনে হয়, ইংরেজি ভাষা এ বিবেচনায় আরও বেশি সীমাবদ্ধ এবং দীন। ইরেজিতে ঠাকুর লেখা যায় না, লেখতে হয় ‘টাগোর’। আমরা দিব্যি লিখতে পারি, ডিকেন্স, শেলি- ইচ্ছেমত। তবু ইংরেজদের কোন সমস্যা হয় না, আমাদের হবে কেন? বস্তুত সীমাবদ্ধতাটা ভাষার নয়, বাংলাভাষীর সদিচ্ছার।

তৎসম ও অ-তৎসম শব্দের বানানের পার্থক্য বাংলা ভাষার বানান সমস্যার আরেকটি জটিল কারণ। বিশ্ববিদ্যালয়েও এটি শেখানো হয়। তৎসম শব্দের বানান সংস্কৃত ব্যাকরণের রীতি অনুসরণ করে কিন্তু  অ-তৎসম শব্দের বানানবিধি অন্য রকম। কিন্তু কোনটি তৎসম এবং কোনটি  অ-তৎসম শব্দ তা সাধারণ লোকেরা দূরে থাক, অনেক পণ্ডিতও পুরোপুরি জ্ঞাত নন। সংগত কারণে বানানে ভুরি ভুরি ভুল হচ্ছে। হ্যাঁ, এটা একটা সমস্যা বটে। কিন্তু সমস্যা উত্তরণের চেষ্ট করা হচ্ছে কি? বাংলা ভাষা ও বানান সমস্যার উৎস সমোচ্চারিত শব্দ বা সমোচ্চারিত যুক্ত-ব্যঞ্জন কিংবা তৎসম-অতৎসম শব্দ নয়, বুদ্ধিজীবীদের কলম। রাজা-বাদশা, মন্ত্রী-আমলাদের মত বুদ্ধিজীবীরাই সবচেয়ে বেশি নীতি ভঙ্গ করেন। বাংলায় ‘সমসাময়িক’ শব্দটির বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা গেলেও ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী শব্দটি নাকি অশুদ্ধ। শুদ্ধ রূপ ‘সামসময়িক’; তাহলে আনিসুজ্জামান সাহেব কেন তাঁর গ্রন্থে সমসাময়িক লেখেন? তিনি কি ব্যাকরণের নিয়ম জানেন না? বাংলা বানানের নিয়ম গ্রন্থে মাহবুবুল আলম সাহেব লিখেছেন ‘প্রয়োজনীয়’ শব্দটি অশুদ্ধ, অথচ গ্রন্থের ১৭ পৃষ্ঠায় তিনি ‘প্রয়োজনীয়’ শব্দটি খুব প্রয়োজনের সাথে ব্যবহার করেছেন। এগুলো যদি প্রচলিত হয় তো লেখা হোক, ব্যবহার হোক, কোন সমস্যা নেই। কিন্তু অনেকে এরূপ শব্দকে অশুদ্ধ/অপ্রচলিত/ অসাধু ইত্যাদি বিশেষণে গালি দেবেন কেন? সমতা বিধানে দোষ কোথায়? ভাষা নাকি নদীর মত, আধুনিক বিশ্বে নদী-শাসন সর্বজনবিদিত কার্যকর একটি বিষয়। নদীশাসনের মাধ্যমে নদীর মত অপ্রতিরোধ্য শক্তিকে বশ করা হচ্ছে। নদীকে শাসন করা গেলে নদী-রূপ ভাষাকে কেন শাসন করা যাবে না। আর যদি যায় তো কেনই বা আমরা ভাষা শাসনের জন্য উপযুক্ত কাঠামো গড়ে তুলছি না? অথচ পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে ভাষা-শাসনের জন্য অবকাঠামো রয়েছে। ভাষাকে যে দেশ কিংবা জাতি গুরুত্ব দেয় না তাদের দীনতা কখনও ঘুচে না।

সমতাভিত্তিক বানানরীতির সর্বজনীন গ্রাহ্যতা এবং সম্প্রসারণের অভাব বাংলা বানানের প্রধান সমস্যা। বাংলা বানানরীতির পরিপ্রেক্ষিত সূত্রগুলো শব্দের উৎসভিত্তিক। একজন লোকের পক্ষে বাংলা বানানরীতি যত সহজে আয়ত্তে আনা সম্ভব, বাংলা শব্দের উৎসগুলো আয়ত্তে আনা তত কঠিন। কিন্তু বানানরীতির সমতাবিধানের মাধ্যমে  সহজে কষ্টকর বিষয়টাকে আয়ত্তে নিয়ে আসা যায়। বাংলা ভাষায় বর্তমানে ব্যবহৃত শব্দের সংখ্যা প্রায়  এক লক্ষ পঁচিশ হাজার। তৎমধ্যে আনুমানিক ষাট ভাগ শব্দ তৎসম। শব্দের উৎস সম্পর্কে জ্ঞাত না হলে বানানের নিয়মগুলো যথার্থভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। তবে বাংলা বানানের নিয়মে সমতা ও আদর্শরীতি প্রচলন করা সম্ভব হলে শব্দের উৎসভিত্তিক অসুবিধাগুলো চমৎকারভাবে দূরীভূত সম্ভব। তৎসম-অতৎসমের দ্বন্দ্বে না গিয়ে সকল শব্দকে বাংলা ভাষার নিজস্ব সমৃদ্ধি ধরে নিয়ে অগ্রসর হলে সমস্যা থাকার কথা নয়।

কলাচাষী আর কলাজীবী এক নয়। যারা কলা চাষ করেন তাঁরা কলাচাষী আর কলাচাষীদের কাছ হতে কলা কিনে যারা বিক্রি করেন তাঁরা কলাজীবী। তেমনি যাদের বুদ্ধি নেই কিন্তু বুদ্ধিচাষীদের কাছ হতে সংগৃহীত বুদ্ধি বিকিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁরা বুদ্ধিজীবী। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা যদি কলাজীবীর মত না হয়ে সত্যিকার বুদ্ধিজীবী হতেন তাহলে বাংলা বানানে এত জটিলতা থাকত না। ভাষাভিত্তিক জটিলতাগুলো স¤পূর্ণ দূরীভূত করা সম্ভব না হলেও সুচারু ও গ্রাহ্য বানানরীতি কিংবা সমতাভিত্তিক শাসনের মাধ্যমে জটিলতাকে কাটিয়ে উঠা সম্ভব হত। সপ্তদশ শতকে সৃষ্ট বাংলা ভাষায় এতদিন পরেও এত জটিলতা বিদ্যমান থাকার কোন হেতু থাকতে পারে না। ফসলে আগাছা থাকলে ভাল ফলন হয় না, এটা একজন পাগলও জানেন, অথচ আমরা জানি না, কারণ কী? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে ভুল বানান শিখে বেরিয়ে আসা শিক্ষার্থীরাই ভাষাবিদ হচ্ছেন, পণ্ডিত হচ্ছেন। সংগত কারণে ভুল তাাঁদের পিছু ছাড়ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ লিখিত তিনটি গ্রন্থ পাশাপাশি রেখে দেখেছি, তিনটি গ্রন্থে একই শব্দের তিনটি বানান।  যা সাধারণ্যে বানান ও বানান-রীতি সমস্যার অন্যতম কারণ।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রণীত ‘পরীক্ষা পরিচালনার নিয়মাবলী’ পুস্তিকায় ব্যবহৃত বাংলা শব্দে বানান ভুলের যে বহর চোখে পড়েছে, তাতে মনে হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নয়, জাতীয় বিষবিদ্যালয় পুস্তিকাটি প্রণয়ন করেছেন। সরকারি কাজকারবার দলিলপত্রে এখনও ‘সরকারী’ লেখা হচ্ছে, ফৌজদারী, সাক্ষী, বাদী শব্দগুলো হামেশা ভুল বানানে দিব্যি আরামে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।  একজন ছাত্র ব্যাকরণ বহিতে যা পড়ছে বাইরে এসে রাস্তা-ঘাটে দেখছে ঠিক তার উলটো। কুমিল্লা বোর্ড প্রচারিত নকল বিরোধী প্রচারপত্রে লেখা হয়েছে ‘বহিস্কার’, এটি কোন বিধানের শব্দ তা জনৈক ডেপুটি কন্ট্রোলারকে জিজ্ঞাসা করেও জানা সম্ভব হয় নি। অতএব সাধারণ জনগণ এবং কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে লম্বা-বেটে, ভুল-শুদ্ধ একাকার হয়ে যাচ্ছে। তাই ‘ভুল’ বানান লেখার সময় কখনও ‘ভুল’ আবার কখনও ‘বুল’ লেখা হচ্ছে।

No comments:

Post a Comment